ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৪৭তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রত্যাবর্তন এবং ২০ জানুয়ারি ২০২৫-এ তার অভিষেক, নতুন এক যুগের সূচনা করছে, যা ‘ট্রাম্প ২.০’ নামে পরিচিত। এর পাশাপাশি, বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই দুটি ঘটনা একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন গতিশীলতা সৃষ্টি করেছে, যা বৈশ্বিক রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
জুলাই বিপ্লব: বাংলাদেশের রাজনৈতিক রূপান্তর
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জুলাই বিপ্লব এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছে। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনা ও তার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শাসনকালে দুর্নীতি, জনমানসে আস্থার সংকট এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার কারণে দেশ এক গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক অসন্তোষের মধ্যে ডুবে ছিল। এই প্রেক্ষাপটে, তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে যুব সমাজের থেকে গড়ে ওঠা এক অভূতপূর্ব আন্দোলন হাসিনা সরকারের পতন ঘটায়।
হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ভোটার দমন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিনের। এই আন্দোলন মূলত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে পরিচালিত হয়, যা শেষ পর্যন্ত একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করে।
বিপ্লবের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এই ক্রান্তিকালীন সরকারকে শুরু থেকেই ব্যাপক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- ভঙ্গুর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন,
- আওয়ামী লীগ সমর্থিত সহিংস প্রতিবন্ধকতা সামাল দেওয়া,
- এবং জনগণের গণতান্ত্রিক ও আর্থ-সামাজিক সংস্কারের দাবিগুলোর বাস্তবায়ন।
একই সঙ্গে, প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কাও বিরাজমান। অন্যদিকে, বিএনপির মতো প্রধান বিরোধী দ্ল দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, যা সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। যদিও শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল, ধীর সংস্কার প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেই আশাবাদ ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের হতাশা এবং নতুন আশা
গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চার অবনতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ভিন্নমত দমন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতার একক কেন্দ্রীকরণ—এসব অভিযোগে হাসিনার প্রশাসন বারবার আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে। এই অসন্তোষের বাস্তব প্রকাশ ঘটে যখন প্রেসিডেন্ট বাইডেন বাংলাদেশকে’ডেমোক্রেসি সামিট’ থেকে বাদ দেন। এটি ছিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষের এক স্পষ্ট ইঙ্গিত। বাংলাদেশের ৪৬তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট বাইডেন গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং অবাধ নির্বাচনের গুরুত্ব উল্লেখ করে একটি বার্তা পাঠান। এই বার্তা ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে হাসিনার শাসনের প্রতি দীর্ঘদিনের হতাশার প্রতিফলন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের জন্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ড. ইউনূসকে তার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য প্রকাশ্যে অভিনন্দন জানান। তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে তার আশাবাদ ব্যক্ত করেন এবং দেশের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সংস্কার কার্যক্রমের জন্য পূর্ণ মার্কিন সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন।
এই পদক্ষেপ শুধু কূটনৈতিক পরিবর্তনই নয়; বরং বৃহত্তর সহযোগিতার ইঙ্গিত দেয়। বিশেষত, শাসনব্যবস্থা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এই সমর্থন কাজে লাগিয়ে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে। তবে, এটি বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ কূটনীতি এবং দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত পরিকল্পনার প্রয়োজন।
ট্রাম্প 2.0: বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচন তার পরিচিত “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির প্রত্যাবর্তনের আভাস দেয়। বহুপাক্ষিকতার পরিবর্তে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে তার অগ্রাধিকার এবং প্রতিযোগিতাকে সহযোগিতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার মনোভাব বাংলাদেশের জন্য একদিকে নতুন সুযোগ তৈরি করেছে, অন্যদিকে নতুন চ্যালেঞ্জেরও সূচনা করেছে। বিশেষত, চীনের প্রভাব মোকাবিলায় ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশল বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। তবে, একই সঙ্গে এটি বাংলাদেশের জন্য আরও কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
ড. ইউনূস ও ট্রাম্প: ব্যক্তিগত বিরোধের জটিলতা
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বিরোধ বাংলাদেশের জন্য নতুন সহযোগিতার সম্ভাবনাকে জটিল করে তুলেছে। ডেমোক্র্যাটিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে ইউনূসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক—যেমন বিল ও হিলারি ক্লিনটন, আলেকজান্ডার সোরোস, এবং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন—তাকে রিপাবলিকান নেতৃত্বের কাছে সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।
ট্রাম্পের প্রতি ইউনূসের পূর্বের সমালোচনাও তাদের সম্পর্ককে আরও তিক্ত করেছে। ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ের পর, ইউনূস তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “ট্রাম্পের জয় ছিল যেন এক সূর্যগ্রহণ, যা বিশ্বজুড়ে কালো মেঘের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল।” তার এই মন্তব্য ট্রাম্প শিবিরে ক্ষোভের সঞ্চার করে। এমনকি ২০১৬ সালের নির্বাচনের সময় ইউনূস ট্রাম্পবিরোধী প্রচারণায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
একবার একটি বাংলাদেশি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়, ট্রাম্প জিজ্ঞেস করেন, “ঢাকার সেই মাইক্রো-ফাইন্যান্স লোকটি কোথায়? আমি শুনেছি তিনি আমাকে হারানোর জন্য দান করেছেন।” তার এই বক্তব্য ইউনূসের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্কের তিক্ততা স্পষ্ট করে তোলে এবং এটি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ দিকটি আরও জটিল করে তুলেছে।
এছাড়াও ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময়, ট্রাম্প বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কথিত সহিংসতার বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। দীপাবলির সময় এক এক্স ( টুইটার) বার্তায়, তিনি বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে “বর্বরোচিত” উল্লেখ করেন এবং দাবি করেন, “আমার প্রশাসনের অধীনে এ ধরনের ঘটনা কখনও ঘটত না।”
তার এই মন্তব্য হিন্দু-আমেরিকান ভোটারদের কাছে সমর্থন আদায়ের কৌশল হিসেবে বিবেচিত হলেও, এটি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে।
ট্রাম্প 2.0-এর অধীনে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
ট্রাম্প প্রশাসনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভারসাম্যের উপর নির্ভর করছে। চীনের প্রভাব মোকাবিলার মার্কিন উদ্যোগে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। তবে, ড. ইউনূসের প্রতি ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বিদ্বেষ এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই সম্পর্ককে নাজুক করে তুলতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের কূটনৈতিক নেতৃত্ব কীভাবে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখবে এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার মধ্যে একটি কার্যকর সমন্বয় বাংলাদেশের জন্য সময়োপযোগী চ্যালেঞ্জ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের কৌশলগত দিক
ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব
বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান বঙ্গোপসাগরের কেন্দ্রে এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর অন্তর্ভুক্তি দেশটিকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ট্রাম্প এর ২য় মেয়াদে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রভাব মোকাবিলায় আরো সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এটি বাংলাদেশের জন্য একই সঙ্গে সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
ওয়াশিংটন ঢাকার সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা গড়ে তুলতে চাইবে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য ও অবকাঠামোগত সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য এই দ্বৈত চাপ মোকাবিলা করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল গ্রহণ করা জরুরি। চীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে বেইজিংয়ের ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। বৈচিত্র্যময় অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ ঝুঁকি কমাতে পারে। বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর হতে পারে। তবে ঢাকাকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, কোনো বিদেশি প্রভাব তার সার্বভৌমত্ব বা স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন না করে।
অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্য বিবেচনা
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য একটি প্রধান রপ্তানি বাজার, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে। এই খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি মেরুদণ্ড, যা দেশের মোট জিডিপির ১১% এবং রপ্তানির ৮০% এরও বেশি অবদান রাখে। তবে, ট্রাম্পের সুরক্ষাবাদী নীতি এবং সম্ভাব্য শুল্ক বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ঝুঁকি।
এই ঝুঁকি মোকাবিলায়, বাংলাদেশের উচিত মার্কিন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ রক্ষা করা এবং বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। বিশেষত, বস্ত্রশিল্পের বাইরে প্রযুক্তি, জ্বালানি এবং অবকাঠামোতে মার্কিন বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য নতুন সুযোগ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গের সম্পর্ক উন্নত করার পাশাপাশি বাংলাদেশকে তার অন্যান্য বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক বৈচিত্র্যময় করতে হবে। এই বহুমুখী কৌশল বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী ও টেকসই করে তুলতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য নীতি-প্রস্তাবনা: দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং বহুমুখী কৌশল
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার
বাংলাদেশের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা জোরদার করা এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ড. ইউনূসের মধ্যে যে কোনো ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক উত্তেজনা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করা। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রগতির জন্য তাদের শেয়ার্ড অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
ড. ইউনূসের নির্বাচনী বিজয়ের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিনন্দন বার্তা একটি ইতিবাচক সংকেত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, যা উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করার সুযোগ তৈরি করে। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের বাস্তববাদী নীতির প্রতিফলন, যা বৈশ্বিক রাজনীতি ও বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্ককে গঠনমূলক পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায়।
সংখ্যালঘু নিপীড়ন এবং ভুল তথ্য মোকাবিলা
বাংলাদেশের সরকারকে সংখ্যালঘু নিপীড়নের অভিযোগ এবং ভারতীয় মিডিয়ার ভুল তথ্য প্রচারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সংখ্যালঘু অধিকারের সংবেদনশীল ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে এসব প্রচার সরকারের বৈধতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এক্ষেত্রে সরকারের জন্য দ্বিমুখী কৌশল গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ:
দেশীয় পদক্ষেপ: বাংলাদেশি মিডিয়াকে সক্রিয়ভাবে সঠিক তথ্য প্রচার এবং পাল্টা-আখ্যান তৈরি করতে উৎসাহিত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ: মার্কিন নীতিনির্ধারক, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং অ্যাডভোকেসি গ্রুপের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে ভুল তথ্যের প্রভাব রোধ করতে হবে। এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বোঝাপড়া গড়ে তুলতে সাহায্য করবে এবং দেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি শক্তিশালী করবে।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সংযোগ বৃদ্ধি
বাংলাদেশের উচিত সামরিক জোটে জড়ানোর পরিবর্তে অর্থনৈতিক সহযোগিতায় জোর দেওয়া। বিশেষত, একটি মুক্ত এবং উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশকে চীনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের বিচ্ছিন্ন না করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ কাজে লাগানো উচিত।
জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (AIIB) মতো বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন। এই প্ল্যাটফর্মগুলো উন্নয়ন, জলবায়ু অর্থায়ন, এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করে। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ তার অংশীদারিত্বকে বৈচিত্র্যময় করতে পারে এবং যেকোনো একক দেশের উপর নির্ভরতা কমাতে সক্ষম হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও অর্থায়ন
মার্কিন বৈদেশিক সহায়তা নীতিতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানবিক উদ্যোগে তহবিল হ্রাসের সম্ভাব্য ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশকে বিকল্প দাতা খুঁজে বের করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, এবং উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (GCC)-এর দেশগুলোর সঙ্গে সক্রিয় অংশীদারিত্ব এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও বিমসটেক (BIMSTEC)-এর অধীনে আঞ্চলিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে অংশীদারিত্বে বাংলাদেশকে এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সার্বভৌমত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে।যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রযুক্তি, জ্বালানি, এবং অবকাঠামো বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগানো দরকার। পাশাপাশি, চীনের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রেখে বহুমুখী বাণিজ্য অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে।
উপসংহার
ট্রাম্প ২.০ এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তরণ এক অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যা কৌশলগত দক্ষতা ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতির মাধ্যমে ব্যবহার করতে হবে। যদিও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, বাংলাদেশ সক্রিয় কূটনীতি এবং দূরদর্শী পরিকল্পনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সহযোগিতার ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে।
লেখক পরিচিতি
মোঃ ওবায়দুল্লাহ, ভিজিটিং স্কলার, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন মিসিসিপিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট। তার গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র হলো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সফট পাওয়ার, এবং এশীয় রাজনীতি। যোগাযোগ: [email protected] , +16013079751