বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে এক সংকটময় অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে এক অবিরাম গণআন্দোলনের পর বাংলাদেশ তার দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করে। তবে এই স্বাধীনতা অর্জনের পথ মোটেও সহজ ছিল না। হাসিনা সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টায় এক নৃশংস দমন-পীড়ন চালায়। ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারী, বিরোধী কর্মী এবং সাধারণ নাগরিকদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে ১,৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয় এবং হাজার হাজার আহত হয়। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, নিহতদের মধ্যে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ ছিল শিশু—যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই ঘটনা শুধু একটি সরকার পতনের ঘটনা নয়; এটি ছিল দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের জমে থাকা ক্ষোভ ও অবিচারের বিস্ফোরণ।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের সময় বাংলাদেশে রাজনৈতিক কাঠামো পুরোপুরি বিকৃত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি স্তম্ভ—বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং আইনসভা—আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছিল। বিরোধী দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছিল এবং বিচারের নামে প্রহসন চালিয়ে অনেক নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। বিচার বিভাগ ছিল সরকারের হাতের খেলনা। প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশে ন্যায়বিচার এবং স্বচ্ছতার সমস্ত ভিত্তি ভেঙে পড়ে।
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা ছিল আরেকটি প্রধান সমস্যা। হাসিনা সরকার কোটার মাধ্যমে যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে মেধামী কিন্তু যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দেয়া হয়েছে। ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে দক্ষতা লোকবলের অভাব সৃষ্টি হচ্ছিল। তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ ধীরে ধীরে জমা হচ্ছিল। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং বিরোধী কণ্ঠকে দমন করার জন্য বিভিন্ন আইন জারি করা হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশে একদলীয় শাসনের ভিত্তি গড়ে ওঠে, যেখানে শুধু আওয়ামী লীগের মতামতই গ্রহণযোগ্য ছিল।
১৬ বছরের এই শাসনে শেখ হাসিনা নিজেকে দেশের একমাত্র অভিভাবক হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল। সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে কোনো সমালোচনা দেশদ্রোহিতার শামিল বলে বিবেচিত হতো। গণমাধ্যমকে কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিনা বিচারে আটক, গুম এবং হত্যার ঘটনা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। ফলে জনগণের মধ্যে ভয় এবং ক্ষোভ একইসঙ্গে তৈরি হয়েছিল।
বিপ্লবের সূচনা এবং তরুণ প্রজন্মের জাগরণ
সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে ২০২৪ সালে প্রথম গণআন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় দেশের তরুণ প্রজন্ম—বিশেষ করে জেনারেশন-জেড। এই তরুণরাই আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল। কোটা সংস্কারের দাবি ধীরে ধীরে একটি বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ নেয়। জনগণ বুঝতে পারে, শুধু কোটা ব্যবস্থা নয়, বরং রাষ্ট্রের সর্বস্তরে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান প্রয়োজন।
হাসিনা সরকারের দমন-পীড়নের পর, এই আন্দোলন এক দফার রূপ নেয়—হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে। পরে এই আন্দোলন সর্বস্তরের জনগণের সমর্থন পায় এবং তা জুলাই বিপ্লবে পরিণত হয়। সাধারণ মানুষও এই আন্দোলনে যোগ দেয় এবং সরকারের পতনের দাবি জানাতে শুরু করে। একপর্যায়ে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও সরকারের প্রতি আনুগত্য হারিয়ে ফেলে। ফলে হাসিনা সরকার ভেঙে পড়ে এবং ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়।
ইউনুস সরকারের উত্থান এবং সংস্কারের পথ
হাসিনার পতনের পর, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। যদিও এই সরকার সরাসরি নির্বাচিত ছিল না, এটি বিপ্লবের সফলতার ফলাফল এবং জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের অকার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার করা, যার মধ্যে রয়েছে সংবিধান, আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, পুলিশ এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা।
ইউনুস সরকার সংস্কার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত চারটি কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সংস্কারের লক্ষ্য ছিল রাজনীতিমুক্ত প্রশাসন গঠন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার এবং আমলাতন্ত্রকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করা। তবে, ইউনুস সরকার এখন দুটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—আওয়ামী শাসনামলের আনুগত্যশীল আমলাতন্ত্র এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা।
সংস্কার না নির্বাচন: কোনটি আগে?
বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচন চায়। তারা বিশ্বাস করে, নতুন সরকার ক্ষমতায় এলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। অন্যদিকে, বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী তরুণ প্রজন্ম চায় আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন। তরুণদের মধ্যে বিভেদও তৈরি হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা দাবি করছে, বিপ্লবের কৃতিত্ব তাদের; অপরদিকে বিএনপি এবং জামায়াতপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোও বিপ্লবের দাবিদার।
এই বিভেদ জাতীয় ঐক্যকে দুর্বল করছে। এতে জনমনে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
নতুন রাজনৈতিক শক্তি এবং ভবিষ্যতের পথ
২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, জুলাই বিপ্লবের চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি (এনসিপি) গঠিত হয়। এনসিপি বাংলাদেশের “দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র” গঠনের কথা বলছে—যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সাম্য এবং প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীও একই গণতান্ত্রিক লক্ষ্য নিয়ে এগোতে চায়। কিন্তু তাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে তরুণ নেতৃত্বের অভাব। প্রবীণ নেতারা এখনো এসব দলের নেতৃত্বে রয়েছেন, যা পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে তাদের খাপ খাওয়াতে বাধা সৃষ্টি করছে। তরুণদের নেতৃত্বে নিয়ে আসতে না পারলে, তারা ভবিষ্যতে জনসমর্থন হারাতে পারে।
অপরাধীদের বিচার এবং জবাবদিহিতা
হাসিনার পতনের পর প্রকৃত সংস্কার আনতে হলে অপরাধীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরি। ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের সময় যেসব রাজনৈতিক নিপীড়ন ও সহিংসতা চালানো হয়েছে, তার জন্য দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। বিচার বিভাগ এবং আমলাতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে অবশ্যই এই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এর মাধ্যমে প্রশাসনের অভ্যন্তরে নতুন আস্থা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
অবশ্যই জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়া এই পরিবর্তন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের নেতৃত্ব দিলেও সাধারণ মানুষের মতামত এখনও অনুপস্থিত। এই প্রক্রিয়াকে প্রকৃত গণতান্ত্রিক করতে হলে একটি জাতীয় গণভোটের মাধ্যমে জনগণের মতামত নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ এখন এক সংজ্ঞায়িত মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ এসেছে। ইউনুস সরকারের সফলতা নির্ভর করবে বিচার, সংস্কার এবং রাজনৈতিক সহযোগিতার ওপর। জুলাই বিপ্লব ইতোমধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চেতনা পরিবর্তন করেছে। তরুণ প্রজন্ম দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা আর স্বৈরশাসন মেনে নেবে না। বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে এগোবে নাকি আবার কর্তৃত্ববাদের পথে ফিরে যাবে—তা নির্ভর করছে এই বিপ্লবের চেতনা বজায় রাখার ওপর। ভবিষ্যৎ কেবল রাজনৈতিক দল নয়, জনগণের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করেই নির্ধারিত হবে।
মোঃ ওবায়দুল্লাহ, গ্রাজুয়েট স্টুডেট, পলিটিক্যাল সাইন্স, ইউনিভার্সিটি অফ সাউদারন মিসিসিপি, আমেরিকা
মোঃ সোহরাব হোসেন, সিনিয়র গবেষণা সহকারী, সেন্টার ফর এডভান্সড রিসার্চ , ঢাকা